কে. এম. মিনহাজ উদ্দিন : মানবজাতি আল্লাহ তা’য়ালার সৃষ্টির মধ্যে শ্রেষ্ঠ জীব। এই মানবজাতি বিভিন্ন জাতি ও ধর্মে বিভক্ত। প্রত্যেক ধর্মের অনুসারীদের নিজস্ব ধর্মীয় উৎসব আছে। আছে আনন্দ মুখরিত দিন। তেমনিভাবে মুসলমানদেরও আছে দু’টি উৎসব-আনন্দের দিন। একটি হচ্ছে ঈদুল ফিতর, অপরটি ঈদুল আযহা। এ দেশের বৃহত্তম জনসমষ্টির কাছে ঈদ এমনই এক আনন্দঘন অনুষ্ঠান। আবাল-বৃদ্ধ বণিতার অনুষ্ঠান এটি। ধনী-গরীব বলে কোন পার্থক্য নেই এ দিনে। এ দিনের আনন্দ কোন ব্যক্তি বা বিশেষ গোষ্ঠীর নয়। এ দিনের আনন্দ সকলের। ঈদের দিন এক মুসলমান আরেক মুসলমানের সাথে হিংসা-দ্বেষ ভুলে মিলে যায়। শত্রুতা ভুলে বুকে বুকে জড়িয়ে অনুভব করে এক বেহেস্তি সুখ। এক মুসলমান আরেক মুসলমানদের সাথে ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার এক মহাসুযোগ সৃষ্টি করে ঈদ।
ঈদুল আযহা মুসলিম সমাজের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব। ঈদুল আযহার অপর নাম কুরবানীর ঈদ। আরবী শব্দ ‘কুরবাতুন’ বা ‘কুরবান’ থেকে কুরবানী শব্দের উৎপত্তি। যার অর্থ ত্যাগের মাধ্যমে নৈকট্য লাভ। প্রতি বছর চন্দ্র মাসের ১০ জিলহজ্ব ঈদুল আযহা বিশ্বের মুসলমানদের নিকট উপস্থিত হয় কুরবানীর অফুরন্ত আনন্দ সওগাত ও ত্যাগের উজ্জ্বল মহিমা নিয়ে। এ দিনে বিশ্বের লাখো কোটি মুসলমান বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনায় অনুপ্রাণিত হয়ে আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় হযরত ইব্রাহীম (আ) প্রবর্তিত ত্যাগ ও কুরবানীর আদর্শকে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করে।
পবিত্র কুরআন মাজীদে আল্লাহ পাক ঘোষণা করেছেন, ‘সুতরাং তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে নামায কায়েম কর এবং কুরবানী কর।’ সুরা আল-কাউছার-২। হাদীস শরীফে হযরত যায়ের ইবনে আরকাম (রা) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেছেন, একবার রাসূলের (আ) সাহাবীগণ আরয করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! এ কুরবানী কি জিনিস? উত্তরে তিনি বললেন, ‘এটা তোমাদের পিতা হযরত ইব্রাহীমের (আ) সুন্নাত।’ ইবনে মাজা ও আহমদ।
ঈদুল আযহা বা কুরবানীর ঈদ পালনের একটি বেনজির ইতিহাস রয়েছে। আল্লাহ পাক বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আম্বিয়া-ই কেরামকে বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করেছেন, তাদের মধ্যে হযরত ইব্রাহীমের (আ) পরীক্ষা উল্লেখযোগ্য ও চিরস্মরণীয়। তার পরীক্ষা সমূহের মধ্যে স্বীয় পুত্র হযরত ইসমাঈলকে (আ) আল্লাহর উদ্দেশ্যে কুরবানীর নির্দেশ দেওয়াই ছিল সবচেয়ে কঠিন অগ্নিপরীক্ষা। সে পরীক্ষায় হযরত ইব্রাহীম (আ) ইসমাঈল (আ) ও হযরত হাজেরা অর্থাৎ গোটা পরিবারটিই আল্লাহর নির্দেশকে যথাযথবাবে পালন করেছিলেন। আল্লাহ পাক হযরত ইব্রাহীমের (আ) কুরবানী কবুল করলেন। ইসমাঈল (আ) জাবেহ হলেন না, ইসমাঈলের (আ) স্থলে বেহেস্ত থেকে আনীত দুম্বা যবেহ হয়ে গেল। আল্লাহর নির্দেশ পালনে তাদের জীবনের মায়া মমতা আদৌ স্থান পায়নি। তারা আল্লাহর অসাধারণ প্রেম-প্রীতি, ভালবাসা ও আনুগত্যের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাই আল্লাহ তা’য়ালা তার অন্তরের কুরবানী কবুল করে পুত্র ইসমাঈলের (আ) জীবন উপহার দিয়ে পশু কুরবানীর মাধ্যমে কিয়ামত পর্যন্ত এ সুন্নাত জারি করে দিয়েছেন। হযরত ইব্রাহীম (আ) হতে কিয়ামত পর্যন্ত এটা সুন্নাতে ইব্রাহীমী হিসেবে চালু থাকবে। সেই ঘটনা স্মরণ করে প্রতি বছর বিশ্বের মুসলমানগণ ঈদুল আযহা উদযাপন করে থাকে।
জিলহজ্ব মাসের দশম তারিখে কোন ব্যক্তি যদি নিসাব পরিমাণ অর্থাৎ সাড়ে ৭ তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে ৫২ তোলা রৌপ্যের সমান দ্রব্যাদির মালিক হয় তাহলে প্রত্যেক স্বাধীন ও ধনী মুসলমানের ওপর কুরবানী দেওয়া ওয়াজীব। ঈদুল আযহার তাৎপর্য ও কুরবানীর মহাত্মের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সামর্থ থাকা সত্ত্বেও কুরবানী করেনা সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে’। রাসুল (সা.) মদীনা শরীফে ১০ বছর অবস্থান কালে প্রতি বছরই কুরবানী দিয়েছেন। তিরমিযী।
হযরত আয়েশা (রা) বলেন, রাসুল (সা) বরেছেন, কুরবানীর দিনে আল্লাহর নিকট রক্ত প্রবাহিত (কুরবানী করা) অপেক্ষা প্রিয়তর কোনো কাজ নেই। অবশ্যই কিয়ামতের দিন (কুরবানী দাতার পাল্লায়) কুরবানী পশু তার শিং, পশম ও তার ক্ষুরসহ হাজির হবে। কুরবানীর রক্ত মাটিতে পতিত হওয়ার পূর্বেই আল্লাহর দরবারে পৌঁছে যায়। তাই তোমরা প্রফুল্ল মনে কুরবানী কর। তিরমিযী, ইবনে মাজাহ।
গরু, মহিষ, উট, ভেড়া, ছাগল ও দুম্বা দ্বারা কুরবানী করা যায়। অন্য কোন জন্তু দ্বারা কুরবানী করা অনুমোদন ইসলামে নেই। একটি ছাগল, ভেড়া বা দুম্বা কেবল একজনের পক্ষে এবং গরু, মহিষ ও উট দ্বারা সাতজনের পক্ষে কুরবানী করা যায়। তবে কুরবানীর পশু নির্ধারিত বয়েসের হতে হবে। যেমন-ছাগল, ভেড়া, দুম্বা এক বছর, গরু, মহিষ দু’বছর এবং উট পাঁচ বৎসর বয়সি হতে হবে। কারো কারো মতে, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা ছয় মাসের হলেও কুরবানী জায়েয হবে যদি এগুলো দেখতে এক বছর বয়সের মতো দেখায়।
কুরবানী পশুগুলোর দৈহিক ত্রুটি থেকে মুক্ত থাকা বাঞ্চনীয়। যেমন-কানা, খোড়া, কান কাটা, লেজ কাটা, শিং ভাঙ্গা ও পাগল পশু দ্বারা কুরবানী করা নাজায়েয। দুর্বল, মজ্জা শুকিয়ে গেছে বা হেঁটে কুরবানীর স্থানে যেতে পারেনা এমন পশু দ্বারা কুরবানী করা ঠিক হবে না। কুরবানী দাতা নিজ হাতে কুরবানী পশু জবেহ করা উত্তম, তবে প্রয়োজনে অন্য লোক দ্বারাও জবেহ করা যেতে পারে। কুরবানী গোশত নিজেও খেতে পারবে এবং অন্যকেও খাওয়াতে পারবে। যাকে খুশি থাকে প্রদান করতে পারবে। তবে গোশত তিন ভাগ করে এক ভাগ নিজের জন্য এক ভাগ আত্মীয়-স্বজনের জন্য এবং অপর এক ভাগ দরিদ্র, নিস্বদের মাঝে বিলিয়ে দেওয়া মুস্তাহার। নবী করিম (সা) বলেছেন, ‘তোমরা মোটা-তাজা পশু দ্বারা কুরবানী কর। কেননা এ পশু ফুলসিরাতে তোমাদের সওয়ারী হবে।’
রাসুল (সা) আরো বলেছেন, ‘হে ফাতিমা আপন কুরবানীর নিকট যাও। কুরবানীর প্রথম রক্ত বিন্দুতে তোমার সমস্ত গোনাহ মাফ হবে এবং জন্তুটি কিয়ামতের দিন সমুদয় রক্ত, মাংস ও শিং নিয়ে উপস্থিত হবে এবং তোমার আমলের পাল্লা ৭০ গুণ ভাড়ি হবে।’ মানুষের জীবনে সকল জিনিসের চেয়ে আল্লাহ এবং তার নির্দেশকে সর্বাগ্রে স্থান দেওয়া শিক্ষা রয়েছে কুরবানীতে। কাম, ক্রোধ, লোভ, লালসা প্রভৃতি খোদাপ্রেম বিরোধী রিপুগুলোকে আল্লাহ তা’য়ালার নির্দেশ অনুযায়ী বশ ও দমন করার শিক্ষাও রয়েছে কুরবানীতে। প্রতি বছর আমাদের মাঝে ঈদুল আযহা ও কুরবানীর ঈদ ফিরে আসে ত্যাগের মহিমা ও আদর্শ নিয়ে। ত্যাগ ছাড়া কখনোই কল্যাণকর কিছু অর্জন করা যায় না। ত্যাগের মধ্যেই রয়েছে প্রশান্তি ও অফুরন্ত রহমত। কুরবানী অর্থ ত্যাগ বা উৎস্বর্গ করা, তাই আমাদেরকে চিন্তা করে দেখতে হবে যে, আমরা কি আমাদের মাঝে লুকিয়ে থাকা লোভ-লালসা, মিথ্যা, অনাচার, অবিচার, অত্যাচার, জুলুম, হানাহানি, স্বার্থপরতা, দাম্ভিকতা, আত্মম্ভরিতা, অহমিকা, দুর্নীতি, সুদ, ঘোষ, গিবদ, পরনিন্দা, হিংসা, বিদ্বেষ, চুরি, ডাকাতি, সন্ত্রাসী ইত্যাদিকে কুরবানী দিতে তথা ত্যাগ করতে পারছি কি না, না কি ঈদকে মুসলমানের একটি নিছক ধর্মীয় আমোদ-ফুর্তি, দিবস হিসেবেই গ্রহণ করছি।
কুরবানীর মাধ্যমে হযরত ইব্রাহীম (আ) যে ত্যাগের আদর্শ স্থাপন করে গেছেন তার সুন্নাত হিসেবে কুরবানী পালন করা যেন আমাদের জন্য কেবল গোশত খাওয়াতেই পরিণত না হয়। মহান আল্লাহর এই বাণীর কথা অবশ্যই আমাদেরকে স্মরণ রাখতে হবে। অর্থাৎ ‘আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না উহাদের গোশত এবং রক্ত বরং পৌঁছায় তোমাদের তাক্ওয়া তথা খোদাভীতি।’ সুরা হজ্জ-৩৭।
কুরবানী একমাত্র মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের রেজামন্দি হাসিলের উদ্দেশ্যে করতে হবে। এতে কোন রকম সামাজিকতা লোক দেখানো বা দামের প্রতিযোগিতা দেখানো হলে আল্লাহর দরবারে তা কবুল হবে না। কেননা আল্লাহ তা’য়ালা পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন, যার ইরশাদ হচ্ছে, ‘হে রাসুল (সা) আপনি বলুন, নিশ্চয়ই আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও মরণ বিশ্বের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য উৎস্বর্গকৃত। সুরা-আন’আম-১৬২।
ঈদুল আযহা বা কুরবানীর ঈদ থেকে আমরা এটাই শিক্ষা নিতে পারি, আমাদের আশপাশে যারা গরীব-দুঃখী, অভাবী ও অসহায় যাকাত প্রদানের মাধ্যমে আমরা তাদের মুখে হাসি ফুটিয়ে ঈদের আনন্দে শরীক করে নিতে পারি। তাহলে ঈদের আনন্দ পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে। পবিত্র ঈদুল আযহার আনন্দ সবাইকে ছুঁয়ে যাক-এটাই ঐকান্তিক কামনা।
লেখক : সভাপতি, মউশিক শিক্ষক কল্যাণ পরিষদ সিলেট বিভাগীয় কমিটি।