বিচার বিভাগের দুর্নীতি প্রতিরোধে সংস্কার কমিশনের সুপারিশনামা
জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২০:৫২
বিচার বিভাগের দুর্নীতি প্রতিরোধে সংস্কার কমিশনের যত সুপারিশ
বিচার বিভাগের দুর্নীতি প্রতিরোধে সুপ্রিম কোর্ট ও অধস্তন আদালতের জন্য পৃথক সুপারিশ করেছে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন।
শনিবার (৮ ফেব্রুয়ারি) সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ওয়েব সাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে সুপ্রিম কোর্টে দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য নিম্নবর্ণিত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজনের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে…
(ক) সংবিধান অনুসারে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল কর্তৃক সময়ে সময়ে অভিযোগ গ্রহণ ও তা নিষ্পত্তি করাসহ আনুষঙ্গিক বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ।
(খ) সুপ্রিম কোর্টের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের (প্রেষণে কর্মরত জুডিসিয়াল অফিসাররাসহ) বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতির অভিযোগ বিষয়ে অনুসন্ধানের জন্য হাইকোর্ট বিভাগের তিনজন বিচারক সমন্বয়ে গঠিত কমিটি কর্তৃক সময়ে সময়ে অভিযোগ গ্রহণ ও তা নিষ্পত্তি করাসহ দুর্নীতি প্রতিরোধে আনুষঙ্গিক বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ।
অধস্তন আদালতে দুর্নীতি প্রতিরোধে জাতীয় ও জেলা পর্যায়ে কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।
ক. অধস্তন আদালতে দুর্নীতি প্রতিরোধে জাতীয় ও জেলা পর্যায়ে বিচারকদের সমন্বয়ে পৃথক পৃথক কমিটি গঠন করা প্রয়োজন।
খ. জাতীয় পর্যায়ে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকগণের সমন্বয়ে ৩ (তিন) সদস্য বিশিষ্ট একটি প্রাথমিক তদন্ত কমিটি অধস্তন আদালতের বিচারকদের বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতির অভিযোগ বিষয়ে অনুসন্ধান করবেন এবং অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেলে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় সুপারিশ প্রদান করবেন।
গ. জেলা পর্যায়ে অধস্তন আদালতের সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে অভিযোগ গ্রহণ ও তা নিষ্পত্তির জন্য একটি স্থানীয় কমিটি থাকবে যা, ‘দুর্নীতি অনুসন্ধান ও প্রতিরোধ কমিটি’ নামে অভিহিত হতে পারে।
ঘ. প্রতিটি জজশিপে একজন অতিরিক্ত জেলা জজ, একজন যুগ্ম জেলা জজ এবং একজন সিনিয়র সহকারী জজের সমন্বয়ে তিন সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করতে হবে। একইভাবে প্রতিটি ম্যাজিস্ট্রেসিতে একজন এসিজেএম, একজন সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এবং একজন জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সমন্বয়ে ৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করতে হবে। উল্লিখিত দুর্নীতি অনুসন্ধান ও প্রতিরোধ কমিটিগুলো অধস্তন আদালত ও ট্রাইব্যুনালের সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতির অভিযোগ গ্রহণ ও তা নিষ্পত্তি করবেন।
কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, বিভিন্ন সরকারি দপ্তর কর্তৃক প্রদত্ত সেবা দানের ক্ষেত্রে কোনো নাগরিক যদি অসন্তুষ্ট হন তাহলে তিনি অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থাপনা প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে যেকোনো অভিযোগ দিতে পারে। এতদুদ্দেশ্যে সরকার অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থা সংক্রান্ত নির্দেশিকা, ২০১৫ প্রণয়ন করেছে। সরকারি দপ্তরের জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা, সেবার মানোন্নয়ন এবং সুশাসন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এটি একটি অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। ভুক্তভোগী ব্যক্তি কীভাবে অভিযোগ দাখিল করবে এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান কীভাবে অভিযোগ যাচাই-বাছাই, তদন্ত ও নিষ্পত্তি করবে তার একটি রূপরেখা ওই নির্দেশিকায় দেওয়া হয়েছে। বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও স্পর্শকাতরতা বিবেচনায় অনুরূপ একটি অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থা সংক্রান্ত নির্দেশিকা প্রণয়ন এবং তার আলোকে অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থাপনা চালু করার বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নেওয়া হবে
বিচার প্রক্রিয়ায় দোষী সাব্যস্ত না হওয়ার আগে মিডিয়া ট্রায়াল নয়
গাজীপুরসহ সারা দেশে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ শুরু
দুর্নীতি প্রতিরোধে বার-বেঞ্চের ঐক্য
বিচার বিভাগে দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজন বৃহত্তর ঐক্য এবং বার ও বেঞ্চের মধ্যে সমন্বয়। আদালতের যে সহায়ক কর্মকর্তা বা কর্মচারী ঘুষ দাবি বা গ্রহণ করে তার বিষয়ে আইনজীবীরা ওয়াকিবহাল থাকলেও নানা কারণে তারা কর্তৃপক্ষের নিকট অভিযোগ দাখিল করেন না। আবার ঘুষ দিয়ে দ্রুত কাজ আদায় করার জন্য যারা সব সময় সচেষ্ট থাকেন সেইরূপ আইনজীবী বা আইনজীবী সহকারীর বিষয়ে বার কাউন্সিলকেও যথা সময়ে অবহিত করা হয় না। ফলে দুর্নীতির বিষয়টি অনেক সময় ধামাচাপা পড়ে যায়। এ কারণে দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রয়োজন বার ও বেঞ্চের ঐক্য। এছাড়া উপরে বর্ণিত প্রতিটি কমিটি গঠনপূর্বক তাদের শক্তিশালী করা হলে এবং জনসাধারণকে এই সব কমিটির অস্তিত্ব সম্পর্কে অবহিত করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে ভুক্তভোগীরা যথাস্থানে তাদের অভিযোগ জানাতে পারবেন এবং আদালত অঙ্গন হতে দুর্নীতিকে সমূলে উৎপাটন করা সম্ভব হবে।
বিচার বিভাগকে দুর্নীতিমুক্ত রাখতে নিম্নবর্ণিত পদক্ষেপ জরুরি ভিত্তিতে গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে…
১. সুপ্রিম কোর্ট ও অধস্তন সব পর্যায়ের বিচারকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য দুর্নীতি বিরোধী সুষ্পষ্ট বিধানসম্বলিত আচরণবিধিমালা প্রণয়ন।
২. প্রতি তিন বছর পর পর সুপ্রিম কোর্ট এবং অধস্তন আদালতের বিচারকদের সম্পত্তির বিবরণ সুপ্রিম কোর্টে প্রেরণ এবং তা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে জনসাধারণের কাছে প্রকাশ করা।
৩. প্রতি তিন বছর পর পর সুপ্রিম কোর্ট ও অধস্তন আদালতের সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পত্তির বিবরণ সুপ্রিম কোর্টের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের ওয়েব সাইটে এবং অধস্তন আদালতের ক্ষেত্রে জেলা আদালতের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা।
৪. সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ লিখিতভাবে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের কাছে পৌঁছানোর জন্য সুপ্রিম কোর্টে অভিযোগ বাক্স স্থাপন এবং ই-মেইলের মাধ্যমে অভিযোগ দাখিলের জন্য ডেডিকেটেড ইমেইল অ্যাড্রেস জনসাধারণকে প্রদান করা।
৫. অধস্তন আদালতে কর্মরত বিচারকদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের জন্য সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের সমন্বয়ে ৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি প্রাথমিক তদন্ত কমিটি গঠন করা। তদন্ত কমিটি প্রতি ৩ মাস পর পর দাখিল হওয়া অভিযোগগুলো পরীক্ষা এবং অভিযুক্তের বক্তব্য শ্রবণপূর্বক তাতে প্রাথমিক সত্যতা আছে কি না সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে অভিযুক্ত বিচারকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের বা অন্যবিধ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেবেন।
৬. অনুচ্ছেদ (৪) এ উল্লিখিত তদন্ত কমিটিতে অভিযোগ জানানোর জন্য সুপ্রিম কোর্টে একটি অভিযোগ বাক্স স্থাপন এবং একটি ডেডিকেটেড ইমেইল এড্রেস জনসাধারণকে প্রদান করা।
৭. অধস্তন আদালতের সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নিরীক্ষার জন্য জেলা পর্যায়ে গঠিত কমিটি কর্তৃক দাখিল করা সব অভিযোগ পর্যালোচনা করা এবং অভিযুক্ত কর্মকতা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা।
৮. অধস্তন আদালতের সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ দাখিলের জন্য প্রতিটি জজশিপ ও ম্যাজিস্ট্রেসিতে একটি অভিযোগ বাক্স স্থাপন করা এবং ই-মেইলের মাধ্যমে দুর্নীতির শিকার ব্যক্তি যেন তার অভিযোগ জানাতে পারে, সে জন্য জনসাধারণকে ওয়েব সাইটের মাধ্যমে একটি ডেডিকেটেড ইমেইল অ্যাড্রেস (যা প্রতিটি জজশিপ ও ম্যাজিস্ট্রেসির জন্য আলাদা হবে) প্রদান করা।
৯. অধস্তন আদালতের সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য গঠিত কমিটি কর্তৃক প্রতি ০৩ (তিন) মাস পর পর হাইকোর্ট বিভাগের বিচারকগণের সমন্বয়ে গঠিত কমিটির কাছে তাদের কাজের বিবরণ সম্বলিত প্রতিবেদন প্রেরণ করা।
১০. আইনজীবীগণের দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের মাধ্যমে দেশের প্রতিটি জেলায় পৃথক পৃথক অভিযোগ গ্রহণ ও তা নিষ্পত্তির জন্য তদন্ত কমিটি গঠন করা।
১১. বিচারাঙ্গণে দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য একটি অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থাপনা চালু করা